নদীমাতৃক দেশ কাকে বলে? বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয় কেন?

নদীমাতৃক দেশ কাকে বলে

বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট বড় অসংখ্য নদী, যার শাঁখা-প্রশাখা জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেশে ৬৪ টি জেলা জুড়ে। এজন্যই বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ অথবা Riverine country বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে চলা শাখা প্রশাখাসহ ছোট বড় নদীর সংখ্যা ৭০০টি। অর্থনীতি, পরিবহন সর্বোপরি সংস্কৃতির সাথে মিলেমিশে রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য নদী। সর্বোপরি Culture, livelihood এর উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করছে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই নদীগুলো।

শিল্প উৎপাদন, পরিবহন ব্যবস্থা, কৃষি উন্নয়ন ছাড়াও বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের একটা বিরাট অংশ দখল করে আছে এই নদনদী গুলো। এছাড়া বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহাসিক এবং সংস্কৃতিক স্থাপনা গুলো এই নদ নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেহেতু এই নদ নদী গুলোর অবদান কোনোভাবে অস্বীকার করা যায় না তাই বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়ে থাকে। আজকের আর্টিকেলে আমরা নদীমাতৃক দেশ কাকে বলে? বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয় কেন তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

নদীমাতৃক দেশ কাকে বলে

নদীমাতৃক দেশ কাকে বলে

নদীমাতৃক শব্দটিকে যদি ভাঙ্গা হয় তাহলে নদী এবং মাতা দুটি শব্দ বের হয়। বাংলাদেশের মতো দেশের যেখানে নদ-নদী, খাল বিলের কোন শেষ নেই সেহেতু বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা যেতেই পারে। এক কথায় বলতে গেলে, যে দেশের ভূগোল, অর্থনীতি এবং মানুষের জীবনধারার উপর নদী প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে তাকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় নদী গুলো হল পদ্মা, মেঘনা, যমুনা এবং কর্ণফুলী। এই বড় চারটি নদী তার পাড়ের জীবনধারা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করে। দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় এই নদী গুলোর অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। নদীমাতৃক দেশের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো: 

  • দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে নদীর একটি বড় ধরনের ভূমিকা থাকলে তাকেই নদীমাতৃক দেশ বলে,
  • ভূগোল এবং মানুষের জীবনযাত্রার মানকে যথেষ্টভাবে প্রভাবিত করার ভূমিকা থাকলে তাকে নদীমাতৃক দেশ বলা যেতে পারে, 
  • দেশের যোগাযোগ এবং পরিবহন ব্যবস্থায় নদীমাতৃক দেশের নদীর একটি বিরাট অবদান থাকে, 
  • নদীমাতৃক দেশে নদীর সংখ্যাগুলো তুলনামূলক বেশি হবে এবং সেখানে ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের নদী থাকবে, 
  • জনসংখ্যার কিছু অংশের কর্মসংস্থান নদীর মাধ্যমে সংঘটিত হয় নদীমাতৃক দেশে।

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে বাংলাদেশের যে ৭০০ টি নদী রয়েছে তার মোট দৈর্ঘ্য হল ২২, ১৫৫ কিলোমিটার। বাংলাদেশের মধ্যে ছোট্ট একটা দেশে নদনদী এত বিশাল জায়গা দখল করে রয়েছে বলেও বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়ে থাকে। নিচে আমরা আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব বাংলাদেশকে প্রতিমাতৃক দেশ বলার কারণ গুলো কি কি।

বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয় কেন

নদীমাতৃক দেশ কাকে বলে

২০১৩ সালের পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে বাংলাদেশের নদ নদীর সংখ্যা ছিল ৩১০ টি। এবং বর্তমান সময়ের হিসাব মতে নদনদীর সংখ্যা শাখা প্রশাখাসহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০০টি। নদীমাতৃক এই ছোট্ট দেশে গত ৫০ বছরে ২২ হাজার কিলোমিটার নদী পথ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের যেসব জাতীয় নদী গুলো রয়েছে তার পাশ দিয়ে গড়ে উঠেছে বড় বড় নগর এবং বন্দর। বড় নদীগুলো ছাড়াও ছোট নদী এবং শাখা নদী গুলোকে বাদ দিলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের প্রধান জাতীয় নদী গুলো পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী নদী বহু মানুষের জীবন জীবিকার উৎস। যে নদী যে অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় সে নদী সে অঞ্চলের বহু মানুষের কাছে নিজস্ব অবদানের জন্য স্বীকৃত হয়ে থাকে।

তবে প্রতিনিয়ত নদনদীর আকার পরিবর্তন হয়, গতিপথ পরিবর্তন হয়। আবার নদীতে চর পড়ার কারণে নদীর আকৃতি একদিক দিয়ে ছোট হয় অন্যদিকে তার গতিপথ বৃদ্ধি পেয়ে কিছুটা আকার পরিবর্তন করে। যেসব নদীগুলো পাদদেশে অবস্থিত সেগুলো উজানে নদীবাহিত পলিগুলো ধারণ করে নেয়। এর ফলে ধীরে ধীরে নদীর বিস্তৃতি এবং প্রশস্ততা তারও বেশি কমে যেতে থাকে। যেসব নদীগুলোতে একসময় প্রতিনিয়ত জোয়ার ভাটা হতো, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের জীবিকার উৎস ছিল সেসব নদীগুলো এখন মৃতপ্রায়। নদীমাতৃক দেশের উপর বসবাস করেও অনেকে চিন্তা করেন না, যে নদী বাঁচলেই দেশ বাঁচবে।

অনেক বড় বড় নদীর অবস্থা এখন মৃতপ্রায় থাকলেও দীর্ঘদিন পুনর্খনন বা সংস্কার করার কোনো উদ্যোগ সরকার পক্ষ থেকে গ্রহণ করার বা বাস্তবায়ন করার কোন নজির চোখে পড়ে না। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেখানে নদীকে জীবন্ত সত্তা বা লিভিং এনটিটির স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট থেকে। আমরা সচেতন বাঙালি হয়েও মাঝে মাঝে ভুলে যাই, নদীমাতৃক এদেশে নদী সবচেয়ে বেশি অবহেলিত।

কখন একটি দেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা যায়

একটি দেশকে নদীমাতৃক বলে আখ্যায়িত করার আগে কয়েকটি বিবেচ্য বিষয় মনে রাখা জরুরী। কখন একটি দেশকে নদীমাতৃক দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে তা নিচে উপস্থাপন করা হলো:

  • যখন এক বা একাধিক নদী দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, 
  • একটি দেশের বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে যখন বিভিন্ন নদীর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে, 
  • পানীয় জল সরবরাহ, দৈনন্দিন কাজ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে নদী ব্যবহৃত হলে, 
  • যখন কোন দেশে নদী ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে,
  • যখন কোন দেশে মানুষ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নদীর ওপর নির্ভরশীল থাকে,
  • যখন কোন দেশে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবনধারা এবং আয়ের উৎস নদীর উপর নির্ভর করে।

উপরে উক্ত বিষয়গুলি যদি কোন দেশে নদীর সাথে পুরোপুরি অর্থে মিলে যায় সে ক্ষেত্রে সেই দেশটিকে নদীমাতৃক দেশ বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। তবে উপরি উক্ত বৈশিষ্ট্য গুলো যদি কোন দেশে নদীর সাথে পুরোপুরি মিলে না যায় তাহলে তাকে নদীমাতৃক দেশ বলা না গেলেও দেশের অর্থনীতিতে সেসব নদীর গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না। সর্বোপরি, যেকোনো বড় নদী সে দেশে অর্থনীতি এবং সামাজিক জীবনধারায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

নদীমাতৃক দেশগুলোর তালিকা

বর্তমানে প্রায় ১৬ টি দেশ রয়েছে যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নদীর উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। কিন্তু এমন কিছু দেশ রয়েছে যেখানে কোনভাবেই নদীর কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। কৃত্রিম উপায়ে পানি ধরে রাখার জন্য তারা লেক তৈরি করে এবং প্রয়োজনে সেখান থেকে পানি ব্যবহার করে থাকে। চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল ম্যাকাউতে ইয়াওং একটি কৃত্রিম খাল রয়েছে। কিন্তু এদেশে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট হওয়া কোন নদী নেই। 

তবে চেনা সরকারের বিভিন্ন হস্তক্ষেপে বর্তমানে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট এই খালটি অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। তবে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কিছু নদী ব্রাজিল, রাশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থিত। ব্রাজিলের আমাজন নদী নিষ্কাশন অববাহিকা দিক দিয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম নদী গুলোর মধ্যে অন্যতম। আবার অন্যদিকে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৃহৎ নদীর জন্য পরিচিত। তবে পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম যেখানে বৃহৎ নদীগুলো অবস্থিত। তাই বাংলাদেশকে “ নদীর দেশ” নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।

FAQ

১)বাংলাদেশ কত শত নদীর দেশ?

উঃ ২০১৩ সালের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট নদ নদী সংখ্যা ছিল ৩১০ টি। কিন্তু বর্তমান সময়ের হিসাব মতে বর্তমানে বাংলাদেশের মোট নদীর সংখ্যা হল ১০০৮ টি।

২)বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ এর ইংরেজি কি হবে?

উঃ বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশের ইংরেজি ট্রান্সলেশন হলো Bangladesh is a land of river.

৩)বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট নদীর নাম কি?

উঃ বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট নদীর নাম হল গোবরা নদী। এর বর্তমান দৈর্ঘ্য হল ৪ কিলোমিটার (২ মাইল)।

৪)বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ নদী কোনটি?

উঃ বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ নদীর নাম হল ব্রহ্মপুত্র নদ। ব্রহ্মপুত্র নদের উৎপত্তিস্থল ভারত ও তিব্বতের মধ্য দিয়ে তরুণ হিমালয় পর্বতমালক ঘুরে এসে পরবর্তীতে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিশে গিয়েছে।

 আরো পড়ুন 

নদীমাতৃক দেশ সম্পর্কে আমাদের মতামত

নদীমাতৃক এদেশে নদীর অস্তিত্ব ছাড়া জনজীবন কল্পনা করা যায় না। বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং সামগ্রিক জীবনধারায় নদীর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। আজকের আর্টিকেলে আমরা নদীমাতৃক দেশ কাকে বলে? বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয় কেন তা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য আলোচনা করেছি। নদীমাতৃক দেশ সম্পর্কে আপনাদের যদি আর কোন প্রশ্ন থেকে থাকে তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন এবং এরকম তথ্যবহুল আর্টিকেল পাওয়ার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটের সাথেই থাকুন।

Please follow and like us:
fb-share-icon20
Tweet 20
Pin Share20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *