মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবনী
মহানবী সাঃ এর জীবনী: মানব ইতিহাসে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন, যাঁদের আগমন কেবল একটি জাতি বা ভৌগোলিক অঞ্চলকেই বদলে দেয়নি, বরং পুরো মানবজাতির জন্য চিরকালীন দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন ইসলামের শেষ নবী, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)।
তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, যিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন, ভ্রান্ত ও নৈতিক অবক্ষয়ে নিমজ্জিত আরব সমাজে সত্য, ন্যায় ও মানবতার আলোকবর্তিকা প্রজ্বলিত করেছিলেন। তাঁর জীবন শুধু ধর্মীয় ইতিহাস নয়, মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠতম দৃষ্টান্তও বটে।
মহানবী সাঃ এর জন্ম ও বংশ পরিচয়
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আরবের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। এ বছরকে “আমুল ফীল” বা হাতির বছর বলা হয়, কারণ সে বছর আবিসিনিয়ার শাসক আব্রাহা বিশাল হাতির বাহিনী নিয়ে কাবা ধ্বংস করতে এসেছিল, কিন্তু আল্লাহ তাঁর সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে দেন। নবীর পিতা আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব তাঁর জন্মের আগেই মৃত্যুবরণ করেন। মা আমিনা মাত্র ছয় বছর বয়সে তাঁকে অনাথ রেখে চলে যান। এরপর দাদা আবদুল মুত্তালিব এবং পরে চাচা আবু তালিব তাঁর অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেন।
শৈশব ও কৈশোর
শৈশব থেকেই তিনি সত্যবাদিতা, ভদ্রতা ও পরিশ্রমের জন্য পরিচিত ছিলেন। আরব সমাজে তাঁকে “আল-আমিন” বা বিশ্বাসযোগ্য এবং “আস-সাদিক” বা সত্যবাদী উপাধি দেওয়া হয়েছিল। কৈশোরে তিনি মেষপালনের কাজ করতেন। কিছুটা বড় হলে বাণিজ্যের কাজে যুক্ত হন। সৎ ও বিশ্বস্ত বাণিজ্যিক আচরণের কারণে মানুষের আস্থা অর্জন করেন।
বিবাহ ও পারিবারিক জীবন
২৫ বছর বয়সে তিনি মক্কার ধনী ও মর্যাদাশালী ব্যবসায়ী মহিলা খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসায় পরিচালনায় অংশ নেন। খাদিজা তাঁর সততা ও চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে বিবাহ প্রস্তাব দেন। পরে তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। খাদিজা (রা.) ছিলেন নবীর প্রথম ও জীবনের কঠিন সময়ের সর্বোচ্চ সহায়ক। তাঁদের সংসারে কাসিম, আবদুল্লাহ, জয়নব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম ও ফাতিমা (রা.) জন্মগ্রহণ করেন।
নবুওয়াত প্রাপ্তি
৪০ বছর বয়সে, হেরা গুহায় ধ্যানরত অবস্থায়, প্রথম ওহী নাযিল হয়। ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) তাঁকে আল্লাহর বাণী শোনান: “ইকরা” অর্থাৎ “পড়ো”। এই ঘটনাই নবুওয়াতের সূচনা। তিনি আল্লাহর একত্ববাদ, তাওহীদ ও মানবতার দাওয়াত দিতে শুরু করেন। শুরুতে গোপনে, পরে প্রকাশ্যে তিনি মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথে আহ্বান জানান।
মক্কায় দাওয়াত
মক্কার কুরাইশরা তাঁর দাওয়াতকে শত্রুতা দিয়ে প্রতিহত করতে থাকে। তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। অনেক সাহাবীকে শহীদ করা হয়। এর মধ্যেও তিনি ধৈর্য, ন্যায়পরায়ণতা ও মানবিকতায় অবিচল থাকেন। দশ বছর ধরে তিনি মক্কার মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করতে থাকেন।
হিজরত
নির্যাতনের মাত্রা বাড়লে আল্লাহর নির্দেশে নবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীগণ মদিনায় হিজরত করেন। এই হিজরত ছিল ইসলামের ইতিহাসে এক মহৎ ঘটনা, কারণ এখান থেকেই ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে হিজরতের বছরকে ইসলামী ক্যালেন্ডারের সূচনা ধরা হয়।
মদিনায় রাষ্ট্র পরিচালনা
মদিনায় তিনি শুধু ধর্মীয় নেতা নন, বরং রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এখানে তিনি মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করেন, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সাথে চুক্তি সম্পাদন করেন এবং ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতে সমাজ গড়ে তোলেন। মদিনায় আসার পর মুসলিমদের উপর একাধিক যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়—বদর, উহুদ, খন্দক প্রভৃতি। প্রতিটি যুদ্ধে তিনি সাহস, ধৈর্য ও আল্লাহর উপর ভরসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
মক্কা বিজয়
অবশেষে ৮ম হিজরিতে মুসলমানরা মক্কা বিজয় করে। নবী (সাঃ) অভূতপূর্ব দয়া প্রদর্শন করেন। দীর্ঘদিনের নির্যাতনকারী শত্রুদের তিনি ক্ষমা করে দেন। কাবা ঘরকে মূর্তিমুক্ত করে এক আল্লাহর ইবাদতের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এ বিজয়ের পর ইসলাম সমগ্র আরব উপদ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে।
বিদায় হজ্ব
১০ম হিজরিতে তিনি বিদায় হজ্ব পালন করেন। সেখানে তিনি মানবতার সর্বজনীন ঘোষণা দেন—সব মানুষ সমান, কালো-সাদা, ধনী-গরিব, আরব-অনআরবের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। আল্লাহর কাছে যার মর্যাদা সবচেয়ে বেশি, সে হচ্ছে তাকওয়াবান্দা। এই খুতবা মানবাধিকারের চূড়ান্ত ঘোষণারূপে বিবেচিত হয়।
ইন্তেকাল
হিজরতের ১১তম বছরে, ৬৩ বছর বয়সে মহানবী (সাঃ) ইন্তেকাল করেন। তিনি মদিনায় মসজিদে নববীর পাশে সমাহিত আছেন। তাঁর ইন্তেকালের পরও তাঁর দাওয়াত, আদর্শ ও শিক্ষা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং আজও কোটি কোটি মানুষ তাঁর অনুসারী।
চরিত্র ও শিক্ষা
নবীর চরিত্র ছিল সর্বোচ্চ পূতপবিত্র। তিনি সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার, দয়া, ধৈর্য, ক্ষমাশীলতা, বিনয় ও পরোপকারিতার জীবন্ত দৃষ্টান্ত। তাঁর শিক্ষা মানবতার জন্য সর্বজনীন নির্দেশনা:
-
এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস (তাওহীদ)।
-
সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা।
-
মানবসেবা ও দানশীলতা।
-
নারী, শিশু ও দুর্বলদের প্রতি সহমর্মিতা।
-
জ্ঞান অর্জন ও প্রচার।
উপসংহার
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছিলেন শুধু একজন ধর্মীয় নেতা নন, তিনি ছিলেন বিশ্বমানবতার পথপ্রদর্শক। তাঁর জীবনী মানব সভ্যতার সর্বশ্রেষ্ঠ আলো, যেখানে আছে শান্তি, ন্যায়, সমতা ও মানবতার পূর্ণাঙ্গ বার্তা। তাঁর দাওয়াত কেবল আরবের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য। তাই তাঁর জীবন অধ্যয়ন ও অনুসরণ মানবজাতির জন্য কল্যাণকর পথ।