রোজার নিয়ত ও রোজা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

রোজা রাখার আগে নিয়ত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রমজানের রোজা রাখা যেমন ফরজ তেমনি রোজার নিয়ত করাও ফরজ। বাংলায় নিয়তটি এমন হবে, হে আল্লাহ! আমি আগামীকাল পবিত্র রমজানের নির্ধারিত ফরজ রোজা রাখার ইচ্ছা পোষণ করলাম। অথবা “আমি আল্লাহর জন্য রমজানের রোজা রাখতে নিয়ত করলাম।” বিঃ দ্রঃ রোজা রাখার জন্য সাহরির পর অন্তরের দৃঢ় সংকল্প করাই নিয়ত।

রোজা অর্থ বা রোজা কাকে বলে

এর আভিধানিক অর্থ হলো বিরত থাকা, কঠোর সাধনা করা, আত্মসংযম ইত্যাদি। বিরত থাকাঃ সাওম পালনের মাধ্যমে পানাহার সহ নানা রকম বৈধ-অবৈধ কাজ থেকে বিরত থাকা হয, এজন্য একে রোজা বলা হয়।

সুবহে সাদিক থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কিছু পানাহার, পাপাচার ও কামাচার থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম বা রোজা।

রোজার যে নিয়ত বর্তমানে প্রচলিত

বাংলাদেশে রোজার একটি আরবি নিয়ত প্রসিদ্ধ— যেটা মানুষ মুখে পড়ে থাকেন। তবে এটি হাদিস ও ফিকাহের কোনো কিতাবে বর্ণিত হয়নি। তবে কেউ চাইলে পড়তে পারেন। (তবে জেনে রাখা উচিত যে, নিয়ত পড়ার চেয়ে নিয়ত করা গুরুত্বপূর্ণ।)

আরবি নিয়ত

نَوَيْتُ اَنْ اُصُوْمَ غَدًا مِّنْ شَهْرِ رَمْضَانَ الْمُبَارَكِ فَرْضَا لَكَ يَا اللهُ فَتَقَبَّل مِنِّى اِنَّكَ اَنْتَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْم

রোজার নিয়তের বাংলা উচ্চারণ : নাওয়াইতু আন আছুমা গাদাম, মিন শাহরি রমাদানাল মুবারাক; ফারদাল্লাকা ইয়া আল্লাহু, ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নিকা আনতাস সামিউল আলিম।

বাংলায় নিয়ত :

 হে আল্লাহ! আমি আগামীকাল পবিত্র রমজানের তোমার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফরজ রোজা রাখার ইচ্ছা পোষণ (নিয়্যত) করলাম। অতএব তুমি আমার পক্ষ থেকে (আমার রোযা তথা পানাহার থেকে বিরত থাকাকে) কবুল কর, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞানী।

আরো জানুন; তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম,ফজিলত, নিয়ত ও সময়

নিয়ত সম্পর্কিত কিছু জরুরি কথা


আরবি কিংবা বাংলায় মুখে নিয়তের উচ্চারণ বলা জরুরি নয়। এ সম্পর্কে আল্লামা শামি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ফাতাওয়ায়ে শামিতে উল্লেখ করেছেন-
‘আভিধানিক সূত্রে নিয়ত হলো ‘আজম’। আর ‘মনের দৃঢ় সংকল্পকে’ আজম বলা হয়।

ফরয, নফল কোন রোযার জন্যই মুখে মুখে নিয়ত করতে হয় না। নিয়ত মনে মনে করতে হয়। আর এটা মানুষের মনে তখনই হয়ে যায় যখন মানুষ কোন কাজের ইচ্ছা পোষণ করেন। যেমন : ধরুন আপনি আগামীকাল দশটার বাসে ঢাকায় যাবেন। এটা বাস্তবায়ন করার জন্য কি আপনাকে সেটা বিশেষ বাক্যের মাধ্যমে নিজের মনকে জানাতে হয়? কখনই না।

অনুরূপভাবে রোযার জন্য ” নাওয়াইতু আন আসুমা গাদান ” ইত্যাদি কোন আনুষ্ঠানিক নিয়তের প্রয়োজন নেই । সচেতনভাবে সজ্ঞানে কাজ করলে নিয়ত আপনা আপনিই হয়ে যায়।

রোজা ভঙ্গের কারণ

  1. ইচ্ছাকৃত পানাহার করলে।
  2. স্বামী-স্ত্রী সহবাস করলে ।
  3. কুলি করার সময় হলকের নিচে পানি চলে গেলে (অবশ্য রোজার কথা স্মরণ না থাকলে রোজা ভাঙ্গবে না)।
  4. ইচ্ছকৃত মুখভরে বমি করলে।
  5. নস্য গ্রহণ করা, নাকে বা কানে ওষধ বা তৈল প্রবেশ করালে।
  6. জবরদস্তি করে কেহ রোজা ভাঙ্গালে ।
  7. ইনজেকশান বা স্যালাইরনর মাধ্যমে দেমাগে ঔষধ পৌছালে।
  8. কংকর পাথর বা ফলের বিচি গিলে ফেললে।
  9. সূর্যাস্ত হয়েছে মনে করে ইফতার করার পর দেখা গেল সুর্যাস্ত হয়নি।
  10. পুরা রমজান মাস রোজার নিয়ত না করলে।
  11. দাঁত হতে ছোলা পরিমান খাদ্য-দ্রব্য গিলে ফেললে।
  12. ধূমপান করা, ইচ্ছাকৃত লোবান বা আগরবাতি জ্বালায়ে ধোয়া গ্রহন করলে।
  13. মুখ ভর্তি বমি গিলে ফেললে ।
  14. রাত্রি আছে মনে করে সোবহে সাদিকের পর পানাহার করলে।
  15. মুখে পান রেখে ঘুমিয়ে পড়ে সুবহে সাদিকের পর নিদ্রা হতে জাগরিত হওয়া এ অবস্থায় শুধু কাজা ওয়াজিব হবে।

যেসব কারণে রোজা না রাখলে ক্ষতি নেই তবে কাযা আদায় করতে হবে

  • কোনো অসুখের কারণে রোযা রাখার শক্তি হারিয়ে ফেললে অথবা অসুখ বৃদ্ধির ভয় হলে। তবে পরে তা কাযা করতে হবে।
  • গর্ভবতী স্ত্রী লোকের সন্তান বা নিজের প্রাণ নাশের আশঙ্কা হলে রোজা ভঙ্গ করা বৈধ তবে কাযা করে দিতে হবে।
  • যেসব স্ত্রী লোক নিজের বা অপরের সন্তানকে দুধ পান করান রোজা রাখার ফলে যদি দুধ না আসে তবে রোজা না রাখার  অনুমতি আছে কিন্তু পরে কাযা আদায় করতে হবে।
  • শরিয়তসম্মত মুসাফির অবস্থায় রোযা না রাখার অনুমতি আছে। তবে রাখাই উত্তম।
  • কেউ হত্যার হুমকি দিলে রোযা ভঙ্গের অনুমতি আছে। পরে এর কাযা করতে হবে।
  • কোনো রোগীর ক্ষুধা বা পিপাসা এমন পর্যায়ে চলে গেল এবং কোনো দ্বীনদার মুসলিম চিকিৎসকের মতে রোজা
  • ভঙ্গ না করলে তখন মৃত্যুর আশঙ্কা আছে। তবে রোযা ভঙ্গ করা ওয়াজিব। পরে তা কাযা করতে হবে।
  • হায়েজ-নেফাসগ্রস্ত (বিশেষ সময়ে) নারীদের জন্য রোজা রাখা জায়েজ নয়। পরবর্তীতে কাযা করতে হবে।

কোন কোন ক্ষেত্রে রোজা ভঙ্গ করা যাবে?

যে সব কারণে রমজান মাসে রোজা ভঙ্গ করা যাবে কিন্তু পরে কাজা করতে হয় তা এখানে উল্লেখ করা হলো—

  • মুসাফির অবস্থায়
  • রোগ-ব্যাধি বৃদ্ধির বেশি আশঙ্কা থাকলে
  • মাতৃগর্ভে সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে
  • এমন ক্ষুধা বা তৃষ্ণা হয়, যাতে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকতে পারে
  • শক্তিহীন বৃদ্ধ হলে
  • কোনো রোজাদারকে সাপে দংশন করলে।
  • মহিলাদের মাসিক হায়েজ-নেফাসকালীন রোজা ভঙ্গ করা যায়

রোজা ভঙ্গের যেসব কারণে শুধু কাজা আদায় করতে হয়

  • স্ত্রীকে চুম্বন বা স্পর্শ করার কারণে যদি বীর্যপাত হয়
  • ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে
  • পাথরের কণা, লোহার টুকরা, ফলের বিচি গিলে ফেললে
  • ডুশ গ্রহণ করলে
  • বিন্দু পরিমাণ কোন খাবার খেলে তবে অনিচ্ছাকৃত ভাবে বা মনের ভুলে খেলেও রোজা ভাংবে না তবে মনে আসা মাত্রই খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে
  • নাকে বা কানে ওষুধ দিলে (যদি তা পেটে পৌঁছে)
  • মাথার ক্ষতস্থানে ওষুধ দেওয়ার পর তা যদি মস্তিষ্কে বা পেটে পেঁৗছে
  • যোনিপথ ব্যতীত অন্য কোনোভাবে সহবাস করার ফলে বীর্য নির্গত হলে
  • স্ত্রী লোকের যোনিপথে ওষুধ দিলে

নফল রোজার নিয়ত

ফরজ ও ওয়াজিব রোজা ছাড়া অন্যান্য রোজাকে নফল রোজা বলা হয়; নফল মানে অতিরিক্ত, ফরজ বা ওয়াজিব নয়। মূলত এই নফল রোজা দুই প্রকার। প্রথম প্রকার হলো নির্ধারিত বা রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক পালনকৃত, এই প্রকার রোজা সুন্নত। দ্বিতীয় প্রকার হলো অনির্ধারিত, এগুলো মুস্তাহাব। এই উভয় প্রকার রোজাকে সাধারণভাবে নফল রোজা বলা হয়ে থাকে।

আমরা অনেকেই অনেক নফল ইবাদত করে থাকে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আরেকটি নকল করা হচ্ছে সিয়াম পালন করা বা রোজা রাখা অনেকেই আমাদের মধ্যে জানতে চাই যে নফল রোজার জন্য নফল রোজার জন্য আলাদা কোন নিয়ত শেয়ার করার জন্য আলাদা কোন প্রয়োজন আছে কিনা প্রকৃতপক্ষে কথাটি প্রকৃত অর্থেই হচ্ছে,ইচ্ছা পোষণ করা হয় অর্থাৎ আপনি সিয়াম পালনের জন্য ইচ্ছে পোষণ করেছেন এটাই হচ্ছে নিয়ত আলাদাভাবে কোন নিয়ত করার প্রয়োজন নাই।

কাযা রোযার নিয়ত

যে নফল রোযা পালন করা শেষ হয়ে গেছে সে রোযার নিয়ত পরিবর্তন করে সেটাকে রমযানের ছুটে যাওয়া রোযার কাযা হিসেবে ধরা সঠিক নয়। যেহেতু কাযা রোযার নিয়ত রাত থেকে পাকাপোক্ত হওয়া আবশ্যক। কারণ কাযা আমলের হুকুম সময়মত আদায়কৃত আমলের হুকুমের মত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি ফজরের আগে নিয়ত পাকা করেনি তার রোযা নেই”।[সুনানে তিরমিযি (৭৩০), আলবানী সহিহুত তিরমিযি’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

হাদিসটি বর্ণনা করার পর তিরমিযি বলেছেন: আলেমদের নিকট এই হাদিসের অর্থ হচ্ছে- যে ব্যক্তি রমযানের রোযার নিয়ত ফজরের আগে করেনি কিংবা রমযানের কাযা রোযার নিয়ত ফজরের আগে করেনি কিংবা মানতের রোযার নিয়ত রাত থেকে করেনি। তবে, নফল রোযার নিয়ত সকালে করাও বৈধ। এটি ইমাম শাফেয়ি, আহমাদ ও ইসহাকের অভিমত।

রোজার উপকারিতা

রমজানের একটি বিশেষ ফজিলত বা মাহাত্ম্য হচ্ছে,এই পবিত্র রমজান মাসে আল কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।

রমজান মাসের রোজা মানুষকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি দেয়,মানুষের কুপ্রবৃত্তি ধুয়ে মুছে দেয় এবং আত্মাকে দহন করে ঈমানের শাখা প্রশাখা সঞ্জিবীত করে। সর্বোপরি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।

এই মর্মে মহানবী ইরশাদ করেছেন,

“রোজাদারের জন্য দুটি খুশি।

একটি হলো তার ইফতারের সময়, আর অপরটি হলো আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।” — (বুখারী ও মুসলিম)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *